ব্যস্ত জীবনে প্রতিদিনের ক্লান্তি, বিরক্তি, অবসাদ কোনো কিছু থেকেই যেন মুক্তি মেলে না। প্রতিনিয়তই যাপিত জীবন যেন অসহনীয় হয়ে ওঠে। এই স্ট্রেসের জীবন থেকে যেমন পালানো যায় না। মেনে নেয়াও কষ্টকর হয়ে ওঠে। কিন্তু ইচ্ছে করলেই আমরা ভালো থাকতে পারি। শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার পাশাপাশি মানসিকভাবে ভালো থাকতে হবে। নিজের জন্য আলাদা করে একটু সময় বের করতে হবে। নিজেকে নিজের মতো করে ভালোবাসতে হবে।
মানসিকভাবে ভালো থাকতে যোগ ব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই। জীবনকে উপভোগ করতেও মানসিক প্রশান্তি দরকার। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যোগাসন বা ইয়োগা চর্চা করে, এমন লোকের সংখ্যা ছিল ৪ দশমিক ৩ মিলিয়ন। কিন্তু এখন সে সংখ্যা ১৬ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। এটি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ইয়োগা সব ধরনের মানুষের জন্যই উপযোগী। এর জন্য ফিটনেসের দরকার নেই। যেকোনো বয়সেই ইয়োগা শুরু করা যেতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া ভালো। শুরুর দিকে ইয়োগা ১০ থেক ১৫ মিনিটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখুন। পরে আস্তে আস্তে বাড়ানো যেতে পারে।
যোগাভ্যাসে ফিটনেস বাড়ায়, স্ট্রেস কমায়, প্রশান্তি আনে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও এনার্জি বাড়ায়। মানসিক সুস্থতায় যে আসনগুলো আমরা চর্চা করবো-
প্রাণায়াম : বেশিরভাগ সময়ই আমরা বসে কাজ করি। ফলে ফুসফুসের ১০ ভাগই মাত্র কাজে লাগতে পারে। এ প্রাণায়াম ফুসফুসের ক্ষমতা বাড়ায়। সঙ্গে বাড়িয়ে দেয় জীবনী শক্তি।
পদ্ধতি
দুই পায়ের গোড়ালি জোড়া করে দাঁড়ান। এবার দুই হাতের আঙুল একে অন্যের সঙ্গে ক্রস করে থুতনির নিচে রাখুন। দুই হাতের কনুই জোড়া করে বুকের কাছে রাখবেন। এবার মুখ বন্ধ করে খুব ধীরে ধীরে শ্বাস নিন। যতটা সম্ভব বাতাস যেন আপনার ফুসফুসে প্রবেশ করে। শ্বাস নিতে নিতে মনে মনে এক থেকে ছয় গুনুন। এ সময় অপনার কনুই দুটো দু’পাশ থেকে উপরে উঠবে। হাতের পাতার ওপর থুতনি রেখে কনুই দুটো দুই কানের পাশ দিয়ে উপরে তুলুন। দম ছাড়তে ছাড়তে মাথা ও হাত নামিয়ে আনুন।
অর্ধচন্দ্রাসন : দৈনন্দিন ব্যস্ততায় আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি প্রায় সময়ই। যেন ফুরিয়ে আসে প্রাণশক্তি। এ আসনটি বাড়াতে পারে আমাদের এনার্জি লেভেল। পেশির দৃঢ়তা বাড়াবে, মেরুদণ্ড আরও নমনীয় হবে, পেটের পেশিও শক্ত হবে। সঙ্গে নিতম্ব, কোমর ও তলপেটের মেদ কমাতে সাহায্য করবে।
পদ্ধতি
গোড়ালি জোড়া করে দাঁড়ান। হাত দুটো টানটান করে দুই হাতের আঙুল ইন্টারলক করে সোজা করে মাথার উপর কানের পাশ দিয়ে তুলুন। কনুই দুটো কানের পেছনে আটকানো থাকবে। মুখ থুতনি সোজা রাখুন। এবার শ্বাস নিয়ে কোমর থেকে আপনার ডান দিকে যতটা সম্ভব হেলিয়ে দিন। হাত বা পা ভাঁজ করবেন না। শরীর যেন সামনের দিকে ঝুঁকে না আসে। আপনার শরীরটা ঠিক অর্ধচন্দ্রাকার হবে। আরও একটু স্ট্রেস দিয়ে মনে মনে ১০ গুনে ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়ান।
উৎকটাসন : সারাদিন কাজ করতে করতে আমাদের মাসলগুলো কার্যকারিতা হারাতে বসে। এ আসনটি পায়ের বিভিন্ন মাসল শক্ত করতে সাহায্য করে। হিপ জয়েন্ট নমনীয় করে। হাঁটু ও গোড়ালির রক্ত সঞ্চালন ভালো হয়। পায়ের বাত, আর্থারাইটিস ও লাম্বাগো সারে। এ আসনে হাতের গঠন ভালো করে।
পদ্ধতি
দুই পায়ের পাতা ৬ ইঞ্চি ফাঁকা করে দাঁড়ান। দুই হাত সোজা করে কাঁধ বরাবর রেখে সামনে আনুন। হাতের পাতা নিচের দিকে থাকবে। পায়ের পাতা নিচের দিকে থাকবে। এবার সোজা হয়ে পায়ের পাতার ওপর জোর দিয়ে বসতে থাকুন যতক্ষণ না আপনার জংঘা মাটির সঙ্গে সমান্তরাল হয়। গোড়ালি মাটি থেকে ওঠে থাকবে। ঠিক মনে হবে, আপনি একটা চেয়ারে বসেছেন। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে।
দণ্ডায়মান জানুশিরাসন : কাজ করতে করতে অধৈর্য হয়ে আমরা অনেক সময় বসে পড়ি। হারায় মনোসংযোগ। তখন কাজের মানও কমে আসে। মনে অস্থিরতাও বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এ আসনটি বাড়াবে ধৈর্য আর মনকে করবে স্থির। সঙ্গে তলপেট ও পায়ের উপরের অংশের মাংসপেশীও সুগঠিত হয়।
পদ্ধতি
সোজা হয়ে দাঁড়ান। ডান পা সামনের দিকে তুলুন, মেঝের সমান্তরাল করে। সামনের দিকে ঝুঁকে গোড়ালি থেকে এক ইঞ্চি ছেড়ে দুই হাতের তালু দিয়ে ডান পায়ের পাতা ভালো করে ধরুন বা পা সোজা থাকবে। এবার ডান পায়ের গোড়ালি সামনের দিকে এগিয়ে দিন ও পায়ের পাতা নিজের দিকে আনতে চেষ্টা করুন। স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিন। দুই হাতের কনুই দিয়ে আপনার ডান পা চেপে ধরবেন। আপনার মাথাটা এবার ডান হাঁটুর ওপর রাখার চেষ্টা করবেন।
ভুজঙ্গাসন : এই আসনটি প্রায় পুরো শরীরের জন্যই উপকারী। এটি একদিকে যেমন পিঠের ব্যথা কমায় তেমনি লিভার আর প্লিহা ভালো রাখে। সঙ্গে হজমের সমস্যাও দূর হয়।
পদ্ধতি
মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পায়ের গোড়ালি জোড়া করুন। দুই কাঁধের নিচে আপনার হাতের তালু রাখুন। এবার শ্বাস নিতে নিতে শরীরের উপরের অংশ মেরুদণ্ডের ওপর জোর দিয়ে উপরে তুলুন। কনুই শরীরের সঙ্গে লেগে থাকবে। মাথা যতটা সম্ভব পেছনে হেলিয়ে দিন। পেট মাটিতে লেগে থাকবে। ২০ সেকেন্ড এ ভঙ্গিমায় থাকুন। ২০ সেকেন্ড বিশ্রাম নিয়ে আবার করুন।
শবাসন : এই আসনটি সম্পূর্ণ শরীরকে বিশ্রাম দেয়। রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক করে। এ আসনটি প্রতিটি আসন অভ্যাসের পর করা উচিত।
পদ্ধতি
মাটিতে শুয়ে পড়ুন। দুই পা ছড়িয়ে দিন, হাত দেহের দু’পাশে রাখুন। হাতের তালু উপরের দিকে থাকবে। পায়ের পাতা বাইরের দিকে ও গোড়ালি ভেতরে থাকবে। চোখ খোলা থাকবে। স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিন ও ছাড়ুন। দুই মিনিট এ ভঙ্গিমায় থাকুন।
এমনই কিছু সহজ যোগাসন আর সকালে একটু হাঁটাহাঁটি আমাদের শরীর-মনকে যেমন ঝরঝরে করে তেমনি উৎসবের সময়গুলোতে বাড়তি ভোজনে চিন্তায় ফেলে না।
মনে রাখা জরুরি
* একদিনেই ঠিক ভঙ্গিমা রপ্ত করা যাবে না। তাই তাড়াহুড়া করবেন না।
* আসন করার অন্তত ৩ ঘণ্টা আগে খাবার খান।
* আসন করার সময় ২০ মিনিট শ্বাস নাক দিয়ে ছাড়তে হবে। এ সময় মুখ বন্ধ থাকবে। আসন পুরো হলে পুরো শ্বাস ছাড়তে হবে। শ্বাস নেয়া ও ছাড়ার সময় বেশি তাড়াহুড়া করা যাবে না।
* প্রত্যেক আসন দুই বার করে করলে ভালো। মাঝে বিশ্রামের জন্য শবাসন করতে হবে।
* ভালো থাকার ইচ্ছেটা যেমন জরুরি। তেমনি ভালো থাকাটা আরও জরুরি।