News Bangla 24 BD | লেখক, অলেখক এবং বইমেলা
News Head

স্বকৃত নোমান

শুরু হলো অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চা অনেকাংশেই বইমেলাকেন্দ্রিক। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া বেশিরভাগ লেখক মেলাকে সামনে রেখেই পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন। প্রায় সব লেখকেরই নতুন বই প্রকাশিত হয় মেলায়। ফলে গোটা ফেব্রুয়ারি লেখক-প্রকাশক-পাঠকদের উদযাপনের মাস হয়ে ওঠে। আমরা যারা লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত, এ মাসটি সত্যি সত্যি উদযাপন করি। সারা বছর এ মাসটির অপেক্ষায় থাকি। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে ফেব্রুয়ারি মানেই অন্যরকম আনন্দের একটি মাস। শুধু যে নতুন বই প্রকাশের আনন্দ তা নয়, মেলাকে কেন্দ্র করে ঢাকা এবং এর বাইরে থেকে পরিচিত-অপরিচিত লেখকরাও আসেন। তাদের সঙ্গে দেখা, পরিচয়, আড্ডা হয়। পরিচয় হয় নতুন নতুন পাঠকের সঙ্গেও।

প্রতি বছর বইমেলা উপলক্ষে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজারের মতো নতুন বই প্রকাশিত হয়। বইয়ের এই বিপুল প্রকাশ এবং মেলায় ক্রেতাদের ভিড়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় বাঙালি আসলেই বইপ্রেমী। তবে এ কথাও সত্য যে, বইয়ের নামে যা প্রকাশিত হয় এর বেশিরভাগই ঝঞ্জাল। সম্প্রতি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানও এ কথা স্বীকার করে বলেছেন, ‘মেলায় প্রায় ৪ হাজারের মতো বই বের হয়। এর মধ্যে ১০০ থেকে ১৫০টি বই মানসম্পন্ন। বাকি সব মানহীন।’

তার এই মন্তব্য অসত্য নয়। বইয়ের নামে প্রচুর ঝঞ্জাল বের হয়। বুঝে না বুঝে কিংবা অর্থের বিনিময়ে প্রকাশকরা এই ঝঞ্জাল প্রকাশ করেন। তবে বিষয়টিকে আমি খুব নেতিবাচকভাবে দেখি না। বইয়ের নামে এই ঝঞ্জাল থাকলে বড় সমস্যা কিছু দেখতে পাই না। ঝঞ্জালও কিন্তু থাকতে হয়। কেন? কারণ একটা দেশের সাহিত্য পরিমণ্ডলে প্রচুর অলেখক থাকেন। অলেখক বলতে সামগ্রিক অর্থে অকবি, অসাহিত্যিককে বোঝানো হচ্ছে, যারা কবি বা সাহিত্যিক হতে চান, কিন্তু বুদ্ধির মুক্তি না-ঘটাজনিত কারণে বা বোধ-বুদ্ধির স্বল্পতার কারণে হতে পারেন না, অথচ নিজেদের তারা প্রকৃত লেখক ভাবেন বা দাবি করেন। এদের থাকাটাকে আমি খুবই জরুরি বলে মনে করি। এরা আছেন বলেই প্রকৃত লেখকরা আছেন।

এরা এমন একটি বৃত্ত তৈরি করে রেখেছেন, যে বৃত্তের মাঝখানে অবস্থান করেন লেখকরা। এরা অনেকটা সারের ভূমিকা পালন করেন। জমিতে যেমন উর্বরতার জন্য সার দেওয়া হয়, সাহিত্যের জমিনে এরা সার। এরা না থাকলে লেখকদের বেড়ে ওঠাটা মুশকিল হয়ে পড়ত। এরা না থাকলে লেখকের বইটি কেনার মতো পাঠক খুঁজে পাওয়া মুশকিল হতো। কেননা কৃষক বই পড়ে না, ব্যবসায়ী বা শ্রমিকরাও পড়ে না। বই পড়ে এই অলেখক শ্রেণিটি, যারা লেখক হয়ে উঠতে চান, হরদম লেখক-পরিম-লে বিচরণ করেন এবং লেখকের বইটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় মশগুল থাকেন।

হোক বা না হোক এই অলেখকরা লিখে থাকেন, বইমেলায় বইও প্রকাশ করে থাকেন। অর্থাৎ তারা সৃষ্টিশীল চর্চার মধ্যেই আছেন। সৃষ্টিশীল চর্চার মধ্যে না থেকে তারা সন্ত্রাসী চোরাকারবারিও হতে পারতেন। সৃষ্টিশীল চর্চার মধ্যে থাকার কারণে তাদের মধ্যে এমন এক শুভবোধের জন্ম হয়, যার কারণে মানবতার পক্ষে ক্ষতিকর এমন কিছু করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাদের বিবেকে বাধে।

প্রতি বছর বইমেলায় যে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার বা চার হাজার বই বের হয়, এর বেশিরভাগই অলেখকদের বই। আমার লেখক বন্ধুদের অনেকেই এই বিপুল বইয়ের প্রকাশকে নেতিবাচকভাবে দেখে থাকেন। কিন্তু আমি দেখি সম্পূর্ণ ইতিবাচকভাবে।

তারা কেন নেতিবাচকভাবে দেখেন? কারণ একটাই, বই প্রকাশের নামে অপচয় হচ্ছে। তাদের নেতিবাচকতার কারণ কিন্তু এই একটাই। অন্য কোনো কারণ নেই। তারা অন্য কোনো কারণ দেখাতে পারবেন না। এখানে আমার একটা প্রশ্ন আছে। আচ্ছা বলুন তো অপচয় কোথায় হচ্ছে না? একটি রাষ্ট্রের কথাই ধরুন। রাষ্ট্র নিজেই তো অপচয়কারী একটি প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র পরিচালনার নামে কোটি কোটি টাকা অপচয় হয়ে যাচ্ছে। উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে মারণযন্ত্র আবিষ্কারের জন্য যে বিপুল অর্থের অপচয় হচ্ছে তার সিকিভাগের একভাগও তো এক বইমেলায় অপচয় হয় না।

রাজধানী ঢাকার গুলশান, বনানী, বারিধারা বা ধানমণ্ডিতে প্রতিদিন যে অর্থ অপচয় হচ্ছে তা দিয়ে তো একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা আনয়ন সম্ভব। শহরের রাস্তায় এই যে শত শত প্রাইভেট কার চলছে তার মধ্যেও কি অপচয় কম? শুধু একটি মানুষকে বহন করার জন্য শত শত টাকার তেল পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। টেলিভিশনগুলোও কি অপচয় করছে না? দেশে এত টেলিভিশন, কয়টি দেখে মানুষ? প্রতিদিন এত পত্রিকা বেরুচ্ছে, কয়টি পড়ে মানুষ? এত রেডিও, কয়টি শোনে মানুষ?

তার মানে অপচয় সর্বত্র। আপনি এগুলোকে অপচয় বলছেন না, অথচ বই প্রকাশকে অপচয় বলছেন! একটি বই প্রকাশকে আপনি অপচয় বলবেন কোন যুক্তিতে? বইয়ের জন্য অপচয় হলে অসুবিধাটা কোথায়? অপচয়টা তো বইয়েরই জন্য, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য তো নয়। মানুষ তার কল্যাণের জন্য পৃথিবীতে যত উপাদান আবিষ্কার করেছে বই তার মধ্যে প্রধান। হতে পারে বইটিতে আপনার পড়ার মতো কিছু নেই, কিন্তু কারো না কারো তো আছে। বইগুলো তো আর প্রকাশকরা বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেন না। তার মানে কেউ না কেউ বইটি কেনে। কেউ না কেউ বইটি পড়ে। পড়ে তো অন্যায় কিছু করে না।

প্রকাশিত ওই বইটির মধ্যে সন্ত্রাসী হওয়ার কায়দা-কানুন তো লেখা থাকে না, সেটি পড়লে অন্যায় হবে কেন? আপনি বলতে পারেন, বই তো পড়ে না, এমনিই কেনে। অকারণে। লোক দেখানোর জন্য। আমার প্রশ্ন, লোক দেখানোর জন্য মানুষ তো বহু কিছু করে। সোনা-গয়না কেনে, বাহারি পোশাক কেনে, বিউটি পার্লারে যায়। আরো কত কিছুই তো করে। লোক দেখানোর জন্য বই কিনলে অসুবিধা কোথায়? এই কেনাকাটার মধ্য দিয়ে তো একটা বইসংস্কৃতি গড়ে উঠছে, নাকি?

অতএব, সার্বিক বিবেচনায় লেখক পরিমণ্ডলে অলেখকদের থাকাটাকে আমি গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করি। হ্যাঁ, এ কথা বলা যেতে পারে যে, প্রকাশকরা এই অলেখকদের বই ঠিকমতো সম্পাদনা করেন না। প্রকাশকদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ মিথ্যা নয়। আমি স্বীকার করি, প্রকাশকরা পাণ্ডুলিপি নির্বাচনে দায়িত্বশীলতার পরিচয় খুব কমই দিয়ে থাকেন। আশা করছি, এ ক্ষেত্রে প্রকাশকরা আরো বেশি সচেতন হবেন। বিষয়বস্তু যা-ই হোক, অন্তত বইটি যাতে নির্ভুলভাবে প্রকাশিত হয় সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি।

যা হোক, এবারের মেলার একটা ইতিবাচক দিক হচ্ছে এটিকে এক জায়গায় নিয়ে আসা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এর আগে মেলা দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। এক ভাগ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ, অন্যভাগ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এতে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হতো। লেখক-পাঠকদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হতো। এবার আর এটি থাকছে না। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান মেলাকে এক জায়গায় এনে শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। এ জন্য তাকে ধন্যবাদ।

গত তিন বছর বইমেলার অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত তিন বছর মেলা ঠিকমতো জমেনি। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে ছিল অবরোধ। এ কারণে ঢাকার বাইরের লেখক-পাঠকরা মেলায় যোগ দিতে পারেননি। এছাড়া মেলার মাঝামাঝি সময়ে ঠুনকো কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয় একটি প্রকাশনীর স্টল। শেষদিকে দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত হলেন একজন লেখক। ব্যক্তিগতভাবে আমিও নানা অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হই। আশা করি এবারের মেলায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না। বইমেলার নিরাপত্তার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আশা করি যত্নবান হবেন। লেখক-পাঠকরা যাতে ভালোভাবে মেলায় যোগ দিতে পারেন সেই পরিবেশ বজায় থাকুক। বাঙালির এই মেলা হয়ে উঠুক প্রাণবন্ত।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ